
সূর্যটা তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। নদীর জল কমলা রঙের আভায় ঝিকমিক করছে, যেন কোনো অজানা গানের সুর ভেসে আসছে। রিয়া একা দাঁড়িয়ে আছে নদীর তীরে, তার পায়ের নিচে নরম কাদামাটি আর ঘাসের স্পর্শ। তার হাতে একটা পুরনো ডায়েরি, যার পাতাগুলো হলুদ হয়ে গেছে, কিন্তু প্রতিটি পাতায় লেখা আছে তার জীবনের অগোছালো স্মৃতি।
রিয়ার বয়স এখন পঁচিশ। গ্রামের এই নদীতীরে তার শৈশব কেটেছে। ছোটবেলায় সে এখানে বন্ধুদের সঙ্গে খেলত, নৌকায় চড়ত, আর নদীর গান শুনত। কিন্তু শহরে পড়াশোনা আর কাজের জন্য সে এই গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল। এখন, বছর দশেক পরে, সে ফিরে এসেছে। তার মনে একটা অজানা টান, যেন নদী তাকে ডাকছে।
প্রথম স্মৃতি
রিয়া ডায়েরিটা খুলল। প্রথম পাতায় লেখা, “আজ আমি নদীর সঙ্গে কথা বলেছি। সে আমাকে বলল, সবকিছু বদলে যায়, কিন্তু আমি থাকি।” এটা সে লিখেছিল যখন তার বয়স ছিল মাত্র বারো। তখন তার বাবা-মা’র মধ্যে ঝগড়া হতো প্রায়ই। বাবা চাইতেন শহরে চলে যেতে, আর মা গ্রামের এই সহজ জীবন ছাড়তে চাইতেন না। রিয়া তখন নদীর কাছে পালিয়ে আসত। নদীর শান্ত জল তার মনের ঝড় থামাত।
একদিন, সন্ধ্যায়, রিয়া দেখেছিল একটা ছোট নৌকা নদীর মাঝখানে ভাসছে। নৌকায় একজন বুড়ো লোক বসে আছে, তার হাতে একটা বাঁশি। সে বাঁশি বাজাচ্ছিল, আর সেই সুর নদীর জলে মিশে যাচ্ছিল। রিয়া মুগ্ধ হয়ে শুনেছিল। সে বুড়োকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনি কে? এই সুর কোথা থেকে আসে?” বুড়ো হেসে বলেছিল, “এটা নদীর গান। তুমি যদি মন দিয়ে শোনো, তাহলে তুমিও শুনতে পাবে।”
সেই রাতে রিয়া ডায়েরিতে লিখেছিল, “নদীর গান আমাকে শান্তি দেয়। আমি যখন বড় হব, তখনও এই গান শুনব।”
শহরের জীবন
শহরে গিয়ে রিয়ার জীবন বদলে গেল। কলেজ, চাকরি, নতুন বন্ধু—সবকিছু তাকে ঘিরে ধরল। কিন্তু তার মনে সবসময় একটা খালি জায়গা ছিল। শহরের কোলাহল, ব্যস্ততা, আর কংক্রিটের জঙ্গল তার মনকে ক্লান্ত করে দিত। সে প্রায়ই নদীর কথা ভাবত, কিন্তু ফিরে আসার সময় পেত না।
একদিন, অফিসে একটা খারাপ দিন কাটানোর পর, রিয়া তার ডেস্কে বসে ডায়েরিটা খুঁজে পেল। তার কলেজের ব্যাগে এটা পড়ে ছিল, ধুলোয় মলিন। সে পড়তে শুরু করল, আর প্রতিটি পাতায় তার শৈশব ফিরে আসতে লাগল। সেই রাতে সে সিদ্ধান্ত নিল, গ্রামে ফিরে যাবে।
নদীর কাছে ফিরে আসা
নদীর তীরে দাঁড়িয়ে রিয়া এখন বুঝতে পারছে, কেন সে ফিরে এসেছে। নদী তাকে ডেকেছে। সে ডায়েরিটা বন্ধ করে পকেটে রাখল। তারপর নদীর দিকে এগিয়ে গেল। জলের স্পর্শে তার পা ভিজে গেল। সে চোখ বন্ধ করল, আর শুনতে পেল—নদীর গান। সেই বাঁশির সুর, যেন বহু বছর আগের সেই বুড়ো এখনও বাজাচ্ছে।
রিয়া বুঝল, জীবনের সব ঝড়ের মাঝেও কিছু জিনিস অপরিবর্তিত থাকে। নদী তার সঙ্গে কথা বলছে, তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে তার শিকড়ের কথা। সে হাসল। তার মনে একটা নতুন শক্তি জন্ম নিল। সে ঠিক করল, শহরে ফিরে গিয়েও সে নিয়মিত এখানে আসবে। নদীর গান তাকে পথ দেখাবে।
শেষ
রিয়া নদীর তীরে বসে রইল অনেকক্ষণ। তার মনে শান্তি। সে জানে, জীবনের পথে অনেক চড়াই-উতরাই আসবে, কিন্তু নদী সবসময় তার পাশে থাকবে। তার গান তাকে সাহস দেবে, ভালোবাসা দেবে।