রাতের রহস্য

Spread the love

কলকাতার পুরনো গলিতে, যেখানে বাতিগুলো মিটমিট করে জ্বলে আর কুয়াশা রাস্তায় পড়ে থাকে, সেখানে ছিল মিত্রবাড়ি। পুরনো হাভেলির মতো বাড়িটা এখন প্রায় খালি, শুধু একজন বুড়ো কাছারি, গোপাল, আর তার ছেলে রাহুল থাকত। বাড়ির মালিক, সুধীর মিত্র, বছর দশেক আগে রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। গ্রামের লোকেরা বলত, বাড়িটা অভিশপ্ত। কিন্তু রাহুলের কাছে এসব ছিল কুসংস্কার। সে শহর থেকে ফিরে এসেছিল, বাবার সঙ্গে থাকতে, আর বাড়ির পুরনো জিনিসপত্র বেচে কিছু টাকা জোগাড় করতে।

এক রাতে, ঝড়ের মধ্যে, রাহুল বাড়ির দোতলায় পুরনো স্টাডিরুমে বসে ছিল। তার হাতে একটা পুরনো ডায়েরি, সুধীর মিত্রর লেখা। পাতাগুলো হলুদ হয়ে গেছে, কালির অক্ষর মলিন। রাহুল পড়তে শুরু করল। বাবার লেখা ছিল অদ্ভুত—কোনো একটা “চাবি” নিয়ে কথা, যেটা বাড়ির গোপন কক্ষে লুকানো। “চাবিটা সব খুলে দেবে,” লিখেছিলেন সুধীর। “কিন্তু খুঁজতে গেলে বিপদ।”

রাহুলের মাথায় প্রশ্ন ঘুরছিল। কীসের চাবি? কেন বিপদ? সে ডায়েরিটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। ঘরের কোণে একটা পুরনো কাঠের আলমারি ছিল, তার তালা ভাঙা। সে আলমারিটা খুলল, ভেতরে শুধু ধুলো আর কিছু পুরনো কাগজ। কিন্তু তাকের পেছনে, একটা ছোট্ট লোহার বাক্স লুকানো ছিল। রাহুল বাক্সটা বের করল। তালা লাগানো, কিন্তু চাবি নেই।

তখনই সে শুনল—একটা মৃদু টুংটাং শব্দ, যেন ধাতুর ঠোকাঠুকি। শব্দটা আসছিল বাড়ির তলার দিক থেকে। রাহুল একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল। বাড়ির ভেতরটা অন্ধকার, শুধু মোমবাতির আলোয় দেয়ালের ছায়াগুলো নড়ছে। সে রান্নাঘরের কাছে পৌঁছতেই শব্দটা থেমে গেল। কিন্তু তার চোখ পড়ল মেঝেতে—একটা ছোট্ট পিতলের চাবি, ঠিক রান্নাঘরের দরজার পাশে পড়ে আছে।

রাহুল চাবিটা তুলে নিল। এটা কি সেই চাবি, যার কথা ডায়েরিতে লেখা? সে দ্রুত স্টাডিরুমে ফিরে বাক্সটা খুলল। ভেতরে ছিল একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো, আর তার উপর লেখা: “তিন নম্বর ঘর, দেয়ালের পেছনে।” রাহুলের হৃৎপিণ্ড দ্রুত চলতে শুরু করল। তিন নম্বর ঘর ছিল বাড়ির পিছনের দিকে, যেখানে কেউ যায় না। গোপাল বলত, সেখানে সুধীর মিত্রর পুরনো জিনিসপত্র আছে, কিন্তু দরজাটা বন্ধ থাকে।

রাহুল মোমবাতি হাতে তিন নম্বর ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। দরজাটা খোলা ছিল, যদিও সে নিশ্চিত ছিল যে গোপাল সবসময় তালা লাগিয়ে রাখে। ভেতরে ঢুকতেই ঠান্ডা বাতাস তার মুখে লাগল। ঘরটা খালি, শুধু একটা পুরনো দেয়ালঘড়ি টিকটিক করছে। কিন্তু ঘড়ির পেছনে, দেয়ালে একটা ফাটল ছিল, Hawkins, যেন কেউ টেনে ছিঁড়ে দিয়েছে। রাহুল ফাটলের কাছে গিয়ে হাত দিয়ে দেখল, দেয়ালটা ফাঁপা। সে চাপ দিতেই একটা ছোট্ট পাথরের টুকরো সরে গেল, আর তার পেছনে একটা লোহার দরজা দেখা গেল।

তার হাতে যে চাবি ছিল, সেটা দিয়ে দরজাটা খুলল। ভেতরে ছিল একটা ছোট্ট কক্ষ, আর তার মাঝে একটা পুরনো ট্রাঙ্ক। রাহুল ট্রাঙ্কটা খুলল। ভেতরে ছিল কিছু পুরনো কাগজ, একটা ছবি, আর একটা ছোট্ট কাচের শিশি, যার মধ্যে কিছু লালচে তরল। ছবিটায় ছিল সুধীর মিত্র, তার পাশে একজন অচেনা মহিলা। পেছনে লেখা ছিল: “শোভা, ২০১০।” রাহুলের মনে পড়ল, তার বাবা কখনো কোনো শোভার কথা বলেননি।

তখনই সে শুনল—ঘড়ির টিকটিক থেমে গেছে। ঘরটা অন্ধকার হয়ে এলো, যেন মোমবাতির আলোও কমে গেছে। তার পেছনে একটা ছায়া নড়ল। রাহুল ফিরে তাকাল, কিন্তু কেউ ছিল না। তবু তার মনে হলো, কেউ তাকে দেখছে। সে শিশিটা তুলে ধরল। তরলটা যেন নড়ছে, জীবন্ত। তার মাথায় একটা ফিসফিস শুনল: “আমাকে ছেড়ে দে…”

রাহুল শিশিটা ফেলে দিয়ে পিছিয়ে এলো। কিন্তু দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল, আর ঘরের ভেতর একটা ঠান্ডা হাসির শব্দ ভেসে এলো। সে চিৎকার করল, কিন্তু কেউ শুনল না। পরদিন সকালে, গোপাল তিন নম্বর ঘরে এসে দেখল দরজা খোলা, কিন্তু রাহুল নেই। ট্রাঙ্কটা খোলা, শিশিটা ভাঙা, আর মেঝেতে একটা লাল দাগ, যেন কেউ টেনে নিয়ে গেছে।

গ্রামের লোকেরা বলে, মিত্রবাড়ির রহস্য আরও গভীর হয়েছে। কেউ বলে, সুধীর মিত্র ফিরে এসেছেন। কেউ বলে, শোভা কখনো চলে যায়নি।


Spread the love

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top