
ঝড়ের রাত ছিল। গ্রামের শেষ প্রান্তে, পুরনো বটগাছের নিচে অন্ধকারে মিশে থাকা শীতলা মন্দিরটার দিকে তাকিয়ে রিয়ার মনে হলো, কিছু একটা ভুল হয়েছে। তার হাতে একটা মলিন লণ্ঠন জ্বলছিল, আলোটা কাঁপছিল বাতাসে। গ্রামের লোকেরা বলত, এই মন্দিরে কেউ রাতে যায় না। শীতলা দেবীর মূর্তির পেছনে, পুরনো কুয়োর কাছে কিছু একটা লুকিয়ে থাকে—কেউ বলে ভূত, কেউ বলে অভিশাপ। কিন্তু রিয়ার বোন, মিনি, তিন দিন আগে এই মন্দিরের কাছে এসেছিল আর ফিরে আসেনি। গ্রামের লোকেরা খোঁজাখুঁজি বন্ধ করে দিয়েছে, কিন্তু রিয়া পারেনি।
“মিনি!” রিয়া চেঁচিয়ে ডাকল, তার কণ্ঠ বাতাসে মিশে গেল। কুয়োর কাছে পৌঁছে সে থামল। লণ্ঠনের আলোয় কুয়োর মুখটা দেখা গেল—কালো, অতল গর্তের মতো। তার মনে হলো, কেউ তাকে দেখছে। পেছন ফিরে সে মন্দিরের দিকে তাকাল। মূর্তির চোখ দুটো যেন জীবন্ত, আলোর ছায়ায় নড়ছে।
“কে ওখানে?” রিয়ার গলা কেঁপে উঠল। কোনো উত্তর নেই, শুধু বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। সে কুয়োর দিকে এগিয়ে গেল, হাতে একটা দড়ি ধরে। মিনি যদি ওখানে থাকে? যদি পড়ে গিয়ে থাকে? সে দড়িটা বাঁধতে গিয়ে থমকে গেল। কুয়োর ভেতর থেকে একটা ফিসফিস শব্দ ভেসে এলো, যেন কেউ তার নাম ধরে ডাকছে। “রিয়া… রিয়া…”
সে লণ্ঠনটা তুলে ধরল। আলোটা কুয়োর গভীরে পড়তেই একটা ছায়া দেখা গেল—কিছু একটা নড়ছে, ধীরে ধীরে উঠে আসছে। রিয়ার হৃৎপিণ্ড থমকে গেল। এটা মানুষ নয়। ছায়াটার মুখ ছিল না, শুধু দুটো ফাঁকা চোখ, আর তার হাত—না, হাত নয়, কালো ধোঁয়ার মতো কিছু—তার দিকে এগিয়ে আসছে।
“মিনি?” রিয়া ফিসফিস করে বলল, কিন্তু তার পা পিছিয়ে গেল। ছায়াটা আরও কাছে এলো, তার ফিসফিস এখন পরিষ্কার। “আমাকে… ছুঁয়ে… ফেল…” রিয়া দৌড়াতে চাইল, কিন্তু তার পা যেন মাটিতে আটকে গেছে। লণ্ঠনটা হাত থেকে পড়ে গেল, আলোটা নিভে গেল। অন্ধকারে সে শুনল, কেউ তার নাম ডাকছে—মিনির গলায়।
“দিদি, আমি এখানে…” কণ্ঠটা কুয়ো থেকে আসছে। রিয়া আর ভাবতে পারল না। সে দড়িটা ধরে কুয়োর ভেতর ঝুঁকে পড়ল। ঠান্ডা, ভেজা বাতাস তার মুখে লাগল। তারপর সে দেখল—মিনি, কুয়োর তলায়, পানিতে ভাসছে, তার চোখ ফ্যাকাশে, চুল ভেজা। “দিদি, আমাকে বাঁচা…” মিনি বলল, কিন্তু তার গলায় হাসির আওয়াজ মিশে গেল।
রিয়া চিৎকার করে দড়ি ছেড়ে দিল। সে পিছিয়ে এলো, কিন্তু মন্দিরের দরজা এখন বন্ধ। পেছনে ফিরতেই সে দেখল, শীতলা দেবীর মূর্তি আর নেই। তার জায়গায় ছায়াটা দাঁড়িয়ে, তার ফাঁকা চোখ দিয়ে রিয়ার দিকে তাকিয়ে। “তুই… এখানে… থাকবি…” ছায়াটা বলল, আর তার ধোঁয়ার হাত রিয়ার দিকে বাড়ল।
রিয়া চোখ বন্ধ করল, তার মনে শুধু মিনির মুখ। সে জানত না এটা ভূত, না অভিশাপ, না তার নিজের ভয়। কিন্তু যখন সে চোখ খুলল, সে আর মন্দিরে ছিল না। সে কুয়োর ভেতর, ঠান্ডা পানিতে ভাসছে, আর তার চারপাশে ফিসফিস—শত শত কণ্ঠ, তার নাম ধরে ডাকছে।
পরদিন সকালে, গ্রামের লোকেরা মন্দিরে এসে দেখল, কুয়োর পাশে একটা ভাঙা লণ্ঠন পড়ে আছে। রিয়ার কোনো চিহ্ন ছিল না। শুধু কুয়োর ভেতর থেকে একটা ফিসফিস ভেসে আসছিল, এত হালকা যে কেউ শুনতে পেল না।