
সকালের নরম রোদ আমেদাবাদ শহরের উপর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বাভাবিক কোলাহল। যাত্রীরা তাদের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, কেউ হাসিমুখে প্রিয়জনের সঙ্গে বিদায় জানাচ্ছিল, কেউ আবার ব্যস্ত পায়ে চেক-ইন কাউন্টারের দিকে ছুটছিল। এই সবার মাঝে ছিল আরিয়ান, এক সপ্তম শ্রেণির ছাত্র, যে তার বাবার সঙ্গে শহরে এসেছিল নতুন বই কিনতে। কিন্তু তার কল্পনাতেও ছিল না যে, এই দিনটি তার জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর এবং ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সাক্ষী হবে।
আরিয়ানের বাবা, রাজেশ আসারি, আমেদাবাদ মেট্রোর নিরাপত্তারক্ষী। তিনি মেঘানিনগরের একটি ভাড়া বাড়িতে থাকেন, যেটি বিমানবন্দরের খুব কাছে। আরিয়ান প্রথমবার শহরে এসে উত্তেজিত ছিল। বিমানের ওঠানামা দেখতে তার খুব ভালো লাগত। বাবার বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে সে প্রায়ই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত, মাথার উপর দিয়ে বিশাল বিমানগুলো উড়ে যেত। সেদিন দুপুরে, খাওয়া-দাওয়ার পর, আরিয়ান ঠিক করল, একটা বিমানের ভিডিও তুলে গ্রামের বন্ধুদের পাঠাবে। তার মোবাইল ক্যামেরা হাতে নিয়ে সে ছাদে উঠল।
তখনই শুরু হল সেই মুহূর্ত, যা আমেদাবাদের ইতিহাসে কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট এআই-১৭১, লন্ডনগামী বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার, দুপুর ১:৩৮ মিনিটে রানওয়ে ২৩ থেকে টেকঅফ করল। বিমানটিতে ছিল ২৩০ জন যাত্রী এবং ১২ জন ক্রু। আরিয়ানের ক্যামেরা তখন ঠিক বিমানটির দিকে ফোকাস করা। সে ভেবেছিল, এই দৃশ্যটা তার বন্ধুদের মুগ্ধ করবে। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সবকিছু বদলে গেল।
বিমানটি মাত্র ৬২৫ ফুট উচ্চতায় পৌঁছেছিল, যখন হঠাৎ একটা অস্বাভাবিক শব্দ শোনা গেল। আরিয়ানের ক্যামেরায় ধরা পড়ল, বিমানটি আচমকা নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। প্রথমে সে ভাবল, হয়তো এটা অবতরণ করছে। কিন্তু পরক্ষণেই বিমানটি মেঘানিনগরের বিজে মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেল ভবনের উপর ধাক্কা খেল। মুহূর্তের মধ্যে একটা বিশাল বিস্ফোরণ, আগুনের গোলা গ্রাস করল গোটা বিমানটিকে। আরিয়ানের হাত থেকে মোবাইল পড়ে যাওয়ার উপক্রম। সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ছাদের মেঝেতে বসে পড়ল।
দূর থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে, সাইরেনের শব্দে চারদিক মুখরিত। আরিয়ানের প্রথম কাজ ছিল বাবাকে ফোন করা। “বাবা, একটা বিমান ভেঙে পড়েছে! আমি ভিডিও তুলেছি!” তার কণ্ঠে উত্তেজনা আর ভয় মিশে ছিল। রাজেশ তৎক্ষণাৎ ছুটে এলেন। ততক্ষণে আরিয়ানের তোলা ভিডিওটি তার বাবার মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। গোটা বিশ্ব দেখল আমেদাবাদের সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার প্রথম দৃশ্য।
কিন্তু গল্প এখানেই শেষ নয়। দুর্ঘটনার মধ্যে জড়িয়ে পড়ল আরেকটি রহস্য। বিমানটিতে ছিলেন বিশ্বাসকুমার রমেশ, একজন সাধারণ ব্যবসায়ী, যিনি ১১এ আসনে বসেছিলেন। অবিশ্বাস্যভাবে, তিনিই ছিলেন এই দুর্ঘটনার একমাত্র বেঁচে যাওয়া যাত্রী। কীভাবে? কেউ জানে না। রমেশ নিজেই বলেছেন, “আমি শুধু মনে করি, কেউ যেন আমাকে ধাক্কা দিয়ে বিমান থেকে বের করে দিল। চারদিকে পোড়া দেহের স্তূপ, আমি উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ে বেরিয়ে এলাম।” তার শরীরে কয়েকটা আঁচড় আর পোড়া ছাড়া তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। এটা কি ভাগ্য? নাকি কোনো অলৌকিক শক্তি?
এদিকে, আরিয়ানের ভিডিও তদন্তের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। গুজরাত পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ তাকে ডেকে পাঠাল। আরিয়ান, যে এখনও দুর্ঘটনার শক থেকে বেরোতে পারেনি, পুলিশের প্রশ্নের মুখে আরও ভয় পেয়ে গেল। “আমি কিছুই জানি না, শুধু ভিডিও তুলছিলাম,” সে বারবার বলছিল। তবে পুলিশ তাকে আটক করেনি, শুধু তার বিবরণ নিয়েছে। কিন্তু আরিয়ানের মনে একটা প্রশ্ন বারবার ঘুরছিল—বিমানটা কেন ভেঙে পড়ল? কী এমন হল যে মাত্র ৩০ সেকেন্ডে সব শেষ?
তদন্তে উঠে এল কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। বিমানের পাইলট, ক্যাপ্টেন সুমিত সাভারওয়াল, ৮২০০ ঘণ্টার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন লাইন ট্রেনিং ক্যাপ্টেন। তার কো-পাইলট ক্লাইভ কুন্দরেরও ছিল ১১০০ ঘণ্টার অভিজ্ঞতা। টেকঅফের পর পাইলট একটি ‘মে-ডে’ কল করেছিলেন, অর্থাৎ বিপদ সংকেত। কিন্তু এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল থেকে কোনো উত্তর পাওয়ার আগেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তদন্তকারীরা সন্দেহ করছে, ইঞ্জিনে ত্রুটি বা পাখির ধাক্কা (বার্ড স্ট্রাইক) এর কারণে বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। তাছাড়া, সেদিন আমেদাবাদের তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা বিমানের লিফট কমিয়ে দিতে পারে।
কিন্তু আরিয়ানের মনে আরেকটি প্রশ্ন জাগল। তার ভিডিওতে সে স্পষ্ট দেখেছিল, বিমানটি নামার আগে একটা অদ্ভুত আলোর ঝলক দেখা গিয়েছিল। এটা কি কোনো বিস্ফোরণ? নাকি অন্য কিছু? সে তার বন্ধু রাহুলের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলল। রাহুল, যে ইন্টারনেটে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব পড়তে ভালোবাসে, বলল, “দেখ, এটা হয়তো কোনো সন্ত্রাসী হামলা। ১৯৮৫ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার আরেকটা ফ্লাইট বোমা হামলায় ধ্বংস হয়েছিল। হয়তো এটাও তেমন কিছু!”
আরিয়ানের মন আরও অস্থির হয়ে উঠল। সে ঠিক করল, এই রহস্যের গভীরে যাবে। রাতে বাবার ফোন থেকে সে তার ভিডিওটি আরেকবার দেখল। ধীরে ধীরে ফ্রেম-বাই-ফ্রেম এগোতে গিয়ে সে একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করল—বিমানের ডান ইঞ্জিনের কাছে একটা ছোট্ট কিছু, যেন কোনো ড্রোনের মতো। এটা কি সম্ভব? কেউ কি ইচ্ছাকৃতভাবে বিমানটির ক্ষতি করেছে?
এদিকে, বিশ্বাসকুমার রমেশ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে তার দাদার শেষকৃত্যে যোগ দিলেন। তার দাদাও ছিলেন সেই বিমানে, কিন্তু তিনি বাঁচেননি। রমেশের গল্প শুনে আরিয়ানের কৌতূহল আরও বাড়ল। সে রমেশের সঙ্গে দেখা করতে গেল। রমেশ তাকে বললেন, “আমি শুধু একটা কথাই বলব, ছেলে। জীবন একটা চমক। আমি জানি না কীভাবে বেঁচে গেলাম, কিন্তু আমার মনে হয়, কেউ যেন আমাকে এই গল্প বলার জন্য বাঁচিয়ে রেখেছে।”
আরিয়ানের মনে সাহস জাগল। সে তার ভিডিওটি একজন সাংবাদিকের কাছে পাঠাল, যিনি এই দুর্ঘটনার তদন্ত নিয়ে কাজ করছিলেন। সাংবাদিক সেই অদ্ভুত আলো আর ড্রোনের মতো বস্তুটি নিয়ে তদন্ত শুরু করলেন। ধীরে ধীরে উঠে এল একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য—বিমানটির কাছে একটি অজ্ঞাত উড়ন্ত বস্তু (UFO) দেখা গিয়েছিল বলে কিছু প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করেছেন। এটা কি সত্যি? নাকি শুধুই গুজব?
গল্পের শেষ এখানে নয়। আরিয়ান আজও তার ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকায়, কিন্তু এখন তার চোখে শুধু বিমানের ওঠানামা নয়, একটা অজানা রহস্যের ছায়া ভাসে। সে জানে, সত্য যাই হোক, তার ক্যামেরা সেদিন একটা ইতিহাস ধরে রেখেছে। আমেদাবাদের আকাশে সেই আগুনের গোলা, সেই বিস্ফোরণ, আর একমাত্র বেঁচে যাওয়া মানুষটির গল্প—এসব কখনো ভোলার নয়।
সমাপ্তি
এই গল্পটি কাল্পনিক, তবে আমেদাবাদের বিমান দুর্ঘটনার প্রকৃত ঘটনা ও বিবরণের উপর ভিত্তি করে তৈরি। পাঠকদের জন্য রোমাঞ্চ ও রহস্যের মিশেল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।